প্রতিদিন ব্যায়াম করার নিয়ম
সক্রিয় জীবনের জন্য প্রতিদিন ব্যায়াম করা এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং জরুরি অভ্যাস। আধুনিক জীবনযাপনে দীর্ঘ সময় বসে থাকা, মানসিক চাপ এবং অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস আমাদের দেহকে দ্রুত ক্লান্ত করে তোলে। তবে অনেকে ব্যায়াম শুরু করলেও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেন না।
কারণ তারা সঠিক নিয়ম-কানুন সম্পর্কে সচেতন নন। প্রতিদিন মাত্র কয়েক মিনিটের পরিকল্পিত ব্যায়াম আপনার জীবনকে আরও স্বাস্থ্যকর, উদ্যমী এবং সুন্দর করে তুলতে পারে। এই আর্টিকেলে আমরা প্রতিদিন ব্যায়াম করার নিয়ম, সময়, পদ্ধতি এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
সকালে ব্যায়াম করার উপকারিতা
সকালে ব্যায়াম করলে আমার দিনের শুরুটাই একেবারে অন্যরকম লাগে। ঘুম থেকে উঠে শরীর একটু অলস থাকে, কিন্তু কয়েক মিনিট হালকা স্ট্রেচিং বা হাঁটাহাঁটি করলেই মনে হয় শরীরটা পুরোপুরি জেগে উঠেছে। বিশেষ করে ঠান্ডা সকালের বাতাসে ব্যায়াম করলে বুকে একটা সতেজভাব আসে, যা সারাদিন মাথা পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। অনেকদিন লক্ষ্য করেছি,যেদিন সকালে ব্যায়াম করি, সেই দিনটা অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি ফলপ্রসূ যায়।
আরেকটা জিনিস আমি খুব ভালোভাবে বুঝেছি,সকালের ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে দারুণ কাজ করে। আমরা প্রতিদিন কাজের চাপ, চিন্তা বা নানা দায়িত্বে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। সকালে দশ–পনেরো মিনিট ব্যায়াম করলে শরীরে ভালো লাগার হরমোন নিঃসৃত হয়, যা মনটাকে অনেক হালকা করে দেয়। ব্যায়াম করার পর যে সতেজ ও শান্ত অনুভূতি হয়, সেটা বাকি দিনের কথাবার্তা, কাজকর্ম বা সম্পর্ক,সব কিছুতেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শরীরের শক্তি ও মেটাবলিজম বাড়াতেও সকালে ব্যায়ামের জুড়ি নেই। আমি নিজে দেখেছি, সকালে ব্যায়াম করার অভ্যাস তৈরি হওয়ার পর সারাদিন ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে থাকে, অযথা খাবার খাওয়ার ইচ্ছা কমে যায়। শরীরের ক্যালরি খরচও স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়ে, ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক সহজ হয়। যাঁরা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য সকালের ব্যায়াম সত্যিই খুব কার্যকর।
ঘরে ব্যায়াম করার নিয়ম
ঘরে ব্যায়াম করার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিয়মিততা ও সঠিক রুটিন মেনে চলা। প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি সময় ঠিক করে নিলে শরীরও সেই রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ব্যায়াম শুরুর আগে হালকা ওয়ার্ম-আপ করলে পেশি নমনীয় হয় এবং আঘাত পাওয়ার ঝুঁকিও কমে। নিজের সক্ষমতার ওপর ভরসা রেখে ধীরে ধীরে রেপ বা সময় বাড়ানো ভালো।একদম শুরুতেই অতিরিক্ত চাপ নিলে উল্টো ক্ষতি হতে পারে।
আরো পড়ুনঃ
লিভার নষ্টের লক্ষণ
যোগ ব্যায়াম করার নিয়ম
যোগ ব্যায়াম (Yoga) এমন এক ধরনের অনুশীলন যেখানে শরীর, মন এবং শ্বাস—তিনটি বিষয়ে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। সঠিক নিয়ম মেনে যোগব্যায়াম করলে শরীরের নমনীয়তা বাড়ে, শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকে এবং মানসিক চাপ কমে। নিচে যোগব্যায়াম করার মূল নিয়মগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
১) পরিবেশ ও প্রস্তুতি
-
শান্ত পরিবেশ: যোগব্যায়াম এমন জায়গায় করা উচিত যেখানে শব্দ কম, বাতাস চলাচল ভালো এবং আলো নরম থাকে। এটি মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে।
-
খালি পেটে অনুশীলন: সাধারণত সকালে বা খাবার খাওয়ার ২–৩ ঘণ্টা পর যোগব্যায়াম করতে বলা হয়। পেট হালকা থাকলে শ্বাস নেওয়া ও বাঁকানো সহজ হয়।
-
আরামদায়ক পোশাক: ঢিলেঢালা, শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচল উপযোগী পোশাক শরীরকে স্বচ্ছন্দ রাখে।
-
মাদুর ব্যবহার: খুব শক্ত বা খুব নরম জায়গায় না করে যোগম্যাট ব্যবহার করা উত্তম, এতে ভারসাম্য রক্ষা সহজ হয়।
২) শ্বাস-প্রশ্বাসের সঠিক নিয়ম
-
শ্বাসের ছন্দ ঠিক রাখা: যোগ আসনের সময় জোর করে শ্বাস নেওয়া বা আটকে রাখা উচিত নয়। স্বাভাবিক ছন্দে শ্বাস নেওয়া-বের করা অবস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করে।
-
প্রাণায়াম ধীরে ধীরে: যদি শ্বাসব্যায়াম করা হয়, তবে শুরুতে ধীরে ধীরে কম সময় নিয়ে করা উচিত, পরে অভ্যাস হলে সময় বাড়ানো যায়।
৩) আসন করার নিয়ম
-
সহজ আসন দিয়ে শুরু: শুরুতেই কঠিন বা উল্টো আসন না করে তাড়াসন, ভুজঙ্গাসন, ত্রিকোণাসন, বালাসন-এর মতো সহজ আসন দিয়ে অভ্যাস শুরু করা ভালো।
-
মনের সঙ্গে শরীরের সমন্বয়: প্রতিটি আসন করার সময় শরীরের ভেতরে টান বা শিথিলতা কোথায় হচ্ছে, সেটা অনুভব করে করতে হবে।
-
জোর না করা: শরীর যতটা অনুমতি দেয় ততটাই বাঁকানো বা টান দিতে হবে। অতিরিক্ত চাপ দিলে চোট লাগতে পারে।
-
ধীরে ধীরে পরিবর্তন: একটি আসন থেকে আরেকটি আসনে যাওয়ার গতিও ধীর ও নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত।
৪) সময় ও নিয়মিততা
-
নিয়মিত অনুশীলন: প্রতিদিন ১৫–৩০ মিনিট করলেও নিয়মিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
-
ধীরে ধীরে সময় বাড়ানো: শুরুতে ১০–১৫ মিনিট করলেও যথেষ্ট। পরে শক্তি ও নমনীয়তা বাড়লে সময় বাড়ানো যায়।
৫) ব্যায়ামের পর শিথিলকরণ
-
শবাসন: যোগব্যায়ামের শেষে কয়েক মিনিট শবাসনে শিথিল হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি পেশিকে বিশ্রাম দেয় এবং মানসিক প্রশান্তি আনে।
সর্বোপরি, যোগব্যায়াম মানে শুধুই ব্যায়াম নয়।চএটি শরীর, মন এবং শ্বাসের সামগ্রিক সামঞ্জস্যের চর্চা। ধৈর্য ধরে, নিয়ম মেনে, নিজের আরাম ও সক্ষমতা অনুযায়ী অনুশীলন করাই যোগের মূল চাবিকাঠি।
ব্যায়াম করার সঠিক পদ্ধতি
ব্যায়াম করার সঠিক পদ্ধতি শুরু হয় নিজের শরীরের চাহিদা বুঝে নেওয়ার মাধ্যমে। প্রথমেই হালকা ওয়ার্ম-আপ দিয়ে শরীরকে প্রস্তুত করা জরুরি।যেমন ৫–১০ মিনিট জগিং, জাম্পিং জ্যাক বা হালকা স্ট্রেচিং। এতে পেশি নমনীয় হয়, রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং ব্যায়ামের সময় আঘাত লাগার ঝুঁকি কমে। ব্যায়াম করার সময় প্রতিটা মুভমেন্ট সঠিক ভঙ্গিতে করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; ভুল ভঙ্গিতে ব্যায়াম করলে ফলাফল যেমন কমে যায়, তেমনি হঠাৎ ব্যথা বা চোটের সম্ভাবনাও থাকে। তাই ধীরে ধীরে রিপিটেশন বাড়ানো এবং শরীর কতটা চাপ নিতে পারছে, তা খেয়াল করা উচিত।
ব্যায়ামের পরে কুল-ডাউন ও স্ট্রেচিং করাও সমানভাবে জরুরি। এতে পেশির টান কমে, শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং পরের দিন ব্যথা অনুভবের সম্ভাবনা কমে যায়। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি পান এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ ব্যায়ামের ফল আরও উন্নত করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিয়মিততা বজায় রাখা,হঠাৎ করে বেশি ব্যায়াম না করে ধীরে ধীরে অভ্যাস তৈরি করা। নিজের সুবিধামতো একটি রুটিন বানিয়ে তাতে স্থির থাকলে ব্যায়াম শুধু শরীর নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও দারুণ উপকারী হয়ে ওঠে।
প্রতিদিনের কাজের মাধ্যমে ব্যায়াম করা ছয়টি উপায়
প্রতিদিনের দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই বেশ কিছু স্বাভাবিক কার্যকলাপ আছে যেগুলো সহজেই ব্যায়ামের কাজ করে দিতে পারে। নিচে এমন ছয়টি উপায় দেওয়া হলো-
১. লিফট না নিয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করা
সিঁড়ি ওঠানামা হলো একটি দুর্দান্ত কার্ডিও ও লেগ ওয়ার্কআউট। এতে ক্যালরি
খরচ বাড়ে এবং পায়ের পেশি শক্তিশালী হয়।
২. হাঁটা বা সাইকেলে যাতায়াত
অল্প দূরত্ব হলে গাড়ি এড়িয়ে হাঁটা বা সাইকেল ব্যবহার করা যায়। এতে শরীর
নড়াচড়া পায়, শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে থাকে ও স্ট্যামিনা বাড়ে।
৩. গৃহস্থালির কাজ করা
ঝাড়ু দেওয়া, মোছা, বাসন ধোয়া বা কাপড় কাচা,এসব কাজ পুরো শরীরকে সক্রিয়
রাখে। বিশেষ করে মোছা বা ঝাড়ু দেওয়া পিঠ, হাত ও পায়ের জন্য ভালো
ওয়ার্কআউট।
৪. দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে বিরতি নিয়ে হাঁটা
প্রতি এক ঘণ্টা পর পর ২–৩ মিনিট দাঁড়িয়ে হাঁটলে রক্তসঞ্চালন ভালো হয়, কোমর
ও ঘাড় ব্যথা কমে এবং শরীর সতেজ থাকে।
৫. ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটা
ফোনে কথা বলার সময় স্থির হয়ে বসে না থেকে হাঁটাহাঁটি করলে অতিরিক্ত কয়েকশো
পদক্ষেপ যোগ হয়ে যায়, যা দৈনিক শারীরিক কার্যকলাপ বাড়ায়।
৬. ভারবহনকারী কাজকে ব্যায়াম হিসেবে নেওয়া
বাজারের ব্যাগ হাতে বহন করা বা পানি ভর্তি জগ তোলা।এগুলো হালকা ওজন তোলার মতো
কাজ করে, যা বাহুর পেশি ও গ্রিপ শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
দিনের কোন সময়টি ব্যায়াম করার জন্য সবচেয়ে ভালো?
অনেকেই দিনের কোন সময় ব্যায়াম করা সবচেয়ে ভালো তা নিয়ে দ্বিধায় থাকেন, কিন্তু সত্য হলো,শরীরের ঘড়ি অনুযায়ী সকালে ব্যায়াম অনেকের জন্যই সবচেয়ে উপকারী। ভোরবেলা বাতাস তুলনামূলক স্বচ্ছ থাকে, মনও সতেজ থাকে, ফলে শরীর ব্যায়ামের প্রতি দ্রুত সাড়া দেয়। সকালে ব্যায়াম করলে দিনজুড়ে শক্তি বাড়ে, মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয় এবং মুডও ভালো থাকে। নিয়মিত সকালে ব্যায়াম করলে একটি স্থায়ী রুটিন তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের জন্য দারুণ ফল দেয়।


অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url